আলোর প্রতিসরণ কাকে বলে? প্রতিসরণের নিয়মগুলো কি কি? প্রতিসরাঙ্ক কাকে বলে?

আলোর প্রতিসরণ একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক ঘটনা। আলো সংক্রান্ত এই ঘটনার সাথে অনেকগুলো বিষয় সম্পর্কিত।  আলোর প্রতিসরণ কাকে বলে? আলোর প্রতিসরণ কিভাবে ঘটে ? আলোর প্রতিসরণের নিয়ম কী ? আলোর প্রতিসরণ সম্পর্কিত কিছু প্রশ্ন- ইত্যাদি বিষয়গুলো জানার চেষ্টা করব।

আলোর প্রতিসরণ কাকে বলে?

আলোক রশ্মি যখন এক স্বচ্ছ মাধ্যম থেকে অন্য স্বচ্ছ মাধ্যমে তীর্যকভাবে আপতিত হয় তখন দ্বিতীয় স্বচ্ছ মাধ্যমে আলোক রশ্মির গতিপথ পরিবর্তন হয়ে যায়। অর্থাৎ আলোক রশ্মি বেঁকে যায়। মাধ্যম পরিবর্তনের সাথে সাথে আলোক রশ্মির এই গতি পরিবর্তনের বিষয়টিকে আলোর প্রতিসরণ বলা হয়।অন্যভাবে,
মাধ্যম পরিবর্তনের সাথে সাথে বিভেদতলে আলোক রশ্মির দিক পরিবর্তনকে আলোর প্রতিসরণ বলা হয়।
আলোর প্রতিসরণ কাকে বলে?
চিত্রঃ আলোর প্রতিসরণ।

আলো রশ্মি ০ ডিগ্রি এবং ৯০ ডিগ্রি ব্যতিত অন্য যে কোন কোণে আপতিত হলে আলোর প্রতিসরণ ঘটে। 

আলোক রশ্মির প্রতিসরণের নিয়ম কি কি?

আলোক রশ্মির প্রতিসরণের নিয়ম কি কি?
চিত্রঃ আলোক রশ্মির প্রতিসরণের নিয়ম।


আলোর প্রতিসরণের সুনির্ধারিত কিছু নিয়ম রয়েছে। নিয়মগুলো -
  • আলোক রশ্মি হালকা মাধ্যম থেকে ঘন মাধ্যমে প্রবেশ করলে প্রতিসরিত রশ্মি অভিলম্বের দিকে সরে আসে । অর্থাৎ আপতন কোণ প্রতিসরণ কোণ অপেক্ষা বড় হয়। 
  • প্রতিসরণের সময় আপতিত আলোক রশ্মি, প্রতিসরিত রশ্মি এবং আপতন বিন্দুতে অঙ্কিত অভিলম্ব একই সমতলে অবস্থিত। 
  • আলোক রশ্মি এক স্বচ্ছ মাধ্যম থেকে অন্য স্বচ্ছ মাধ্যমে প্রবেশ করে প্রতিসরিত হয়ে আবার প্রথম মাধ্যমে ফিরে আসলে আপতন কোণ এবং প্রতিসরণ কোণের মান সমান হয়। 

আলোর প্রতিসরণের উদাহরণ

  • আলোর প্রতিসরণের কারনে রাতের আকাশের তারা গুলো মিটি মিটি করে জ্বলতে থাকে ।
  • মরীচিকা আলোর প্রতিসরণের দ্বারা সৃষ্ট অপটিক্যাল ভ্রম । 
  • আলোর প্রতিসরণের কারনে পানির কণায় আলোক রশ্মির বেঁকে যাওয়ায় আকাশে রংধনু তৈরি হয়। 
  • একটি সুইমিং পুলে আলোক প্রতিসরণের কারণে সুইমিং পুলের তলকে তুলনামুলক অগভীর মনে হয়।
  • সাদা আলোক রশ্মি প্রিজমের মধ্যে দিয়ে গেলে তা সাত টি রঙ্গে বিশ্লিষ্ট হয়ে থাকে। 
  • একটি পেন্সিলকে পানি ভর্তি গ্লাসে রাখলে আলোর প্রতিসরণের কারনে বাঁকা মনে হয়।

আলোর প্রতিসরণের সূত্র

আলোর প্রতিসরণ ২টি সূত্র মেনে চলে।

আলোর প্রতিসরণের প্রথম সূত্রঃ

আপতিত রশ্মি, প্রতিসরিত রশ্মি এবং বিভেদতলের অভিলম্ব একই সমতলে অবস্থান করে।

আলোর প্রতিসরণের দ্বিতীয় সূত্রঃ

দইটি নির্দিষ্ট মাধ্যম এবং একটি নির্দিষ্ট রঙ্গের আলোর জন্য আপতন কোণের সাইন ও প্রতিসরণ কোণের সাইনের অনুপাত সব সময় সমান হয়।
আলোর প্রতিসরণের সূত্র
চিত্রঃ আলোর প্রতিসরণের সূত্র।

 আলোর প্রতিসরাঙ্ক কাকে বলে?

আলো রশ্মি যখন এক মাধ্যম থেকে অন্য কোন মাধ্যমে প্রতিসরিত হয় তখন আপতন কোণ এবং প্রতিসরণ কোণের সাইনের অনুপাত একটি ধ্রুবক। এই ধ্রুবককে প্রথম মাধ্যমের সাপেক্ষে দ্বিতীয় মাধ্যমের প্রতিসরাঙ্ক বলে। আলোর এই প্রতিসরাঙ্কের মান আলোর রং এর ওপর নির্ভর করে। 
এখানে, প্রথম মাধ্যমটি শূন্য হলে , দ্বিতীয় মাধ্যমের প্রতিসরাঙ্ককে উক্ত মাধ্যমের পরম প্রতিসরাঙ্ক বলা হয়। 
আলোর প্রতিসরাঙ্ক কাকে বলে?
চিত্রঃ আলোর প্রতিসরাঙ্ক ।

আলোর প্রতিসরাঙ্কের উদাহরণ

বায়ু মাধ্যমের সাপেক্ষে জল মাধ্যমের প্রতিসরাঙ্ক ১.৩৩। অর্থাৎ আলো রশ্মি যখন বায়ু মাধ্যম থেকে জল মাধ্যমের মধ্যে দিয়ে প্রতিসরিত হয় তখন আপতন কোণ এবং প্রতিসরণ কোণের সাইনের অনুপাত ১.৩৩। 

আলোর প্রতিসরাঙ্কের প্রকারভেদ

প্রতিসরাঙ্ক দুই ভাগে বিভক্ত। যথাঃ 
  • আপেক্ষিক প্রতিসরাঙ্ক
  • পরম প্রতিসরাঙ্ক

আপেক্ষিক প্রতিসরাঙ্ক

নির্দিষ্ট রঙ্গের কোন আলোক রশ্মি যখন এক স্বচ্ছ মাধ্যম থেকে অন্য স্বচ্ছ মাধ্যমে আপতিত হয় তখন আলোক রশ্মির গতিপথ কিছু টা পরিবর্তন হয়। আলোক রশ্মির গতিপথ কিছু টা পরিবর্তীত হওয়ায় আপতন কোণ ও প্রতিসরণ কোণের সাইনের অনুপাত যে ধ্রুবক সংখ্যা  হয় তাকে প্রথম মাধ্যমের সাপেক্ষে দ্বিতীয় মাধ্যমের প্রতিসরাঙ্ক বলা হয়। এ ধরনের প্রতিসরাঙ্ক কে আপেক্ষিক প্রতিসরাঙ্ক বলা হয়। 
আপেক্ষিক প্রতিসরাঙ্ক
চিত্রঃ আপেক্ষিক প্রতিসরাঙ্ক।

ধরা যাক, আলোক রশ্মি 'a' মাধ্যম থেকে 'b'মাধ্যমে আপতিত হয়েছে। 'a' মাধ্যমের প্রতিসরণ কোণের সাইন  এবং 'b'মাধ্যমের প্রতিসরণ কোণের সাইন  

পরম প্রতিসরাঙ্ক

কোন নির্দিষ্ট রঙ্গের আলোক রশ্মি যখন শূন্য মাধ্যম থেকে অন্য কোন স্বচ্ছ মাধ্যমে প্রতিসরিত হয়। তখন  আপতন কোণের সাইন এবং প্রতিসরণ কোণের সাইনের অনুপাতকে পরম প্রতিসরাঙ্গ বলা হয়। 
পরম প্রতিসরাঙ্গ
চিত্রঃ পরম প্রতিসরাঙ্গ।


ধরা যাক, আলোক রশ্মি শূন্য মাধ্যম থেকে 'b'মাধ্যমে আপতিত হয়েছে। শূন্য মাধ্যমের প্রতিসরণ কোণের সাইন  এবং 'b'মাধ্যমের প্রতিসরণ কোণের সাইন  

স্নেলের সূত্র

বিজ্ঞানী স্নেলের সূত্রানুসারে, আপতন কোণ এবং প্রতিসরণ কোণের কোসাইনের অনুপাত সর্বদা ধ্রুব থাকে। একে মিউ (`\mu`) বলা হয়।
অর্থাৎ
কোন মাধ্যম থেকে আগত আলোক রশ্মি দ্বিতীয় কোন মাধ্যমের তলের উপর লম্বভাবে আপতিত হলে ওই রশ্মি সোজাসুজিভাবে দ্বিতীয় মাধ্যমে প্রতিসৃত হয়।
সুতরাং
`\mu=\frac{sini}{sinr}`
স্নেলের সূত্রা
চিত্রঃ স্নেলের সূত্র।

আলোর প্রতিসরণ সম্পর্কিত কিছু সাধারণ প্রশ্ন-

জলভর্তি কোন চৌবাচ্চার গভীরতা প্রকৃত গভীরতার তুলনায় কম মনে হয় কেন?

আমরা জানি, কোন বস্তু থেকে আগত আলোক রশ্মি আমাদের চোখে যখন আপতিত হয় তখন আমরা উক্ত বস্তু টি দেখতে পাই। জলভর্তি চৌবাচ্চার তল থেকে প্রতিফলিত আলোক রশ্মি জল মাধ্যম থেকে বায়ূ মাধ্যমে প্রতিসরিত হয়। এখানে ঘনমাধ্যম থেকে আলোক রশ্মি হালকা মাধ্যমে প্রতিসরিত হওয়ায় প্রতিসরিত রশ্মি অভিলম্ব থেকে দূরে সরে যায়। এক্ষেত্রে জলভর্তি চৌবাচ্চার তলদেশ কিছু টা উপরে মনে হয়। 

জলাশয়ের মাছকে উপর থেকে দেখলে মাছকে তার প্রকৃত অবস্থানে না দেখিয়ে কিছুটা উপরে দেখায় কেন?

কোন বস্তু থেকে আগত আলোক রশ্মি আমাদের চোখে যখন আপতিত হয় তখন আমরা উক্ত বস্তু টি দেখতে পাই। জলাশয়ের মাছ থেকে প্রতিফলিত আলোক রশ্মি জল মাধ্যম থেকে বায়ূ মাধ্যমে প্রতিসরিত হয়। এখানে ঘনমাধ্যম থেকে আলোক রশ্মি হালকা মাধ্যমে প্রতিসরিত হওয়ায় প্রতিসরিত রশ্মি অভিলম্ব থেকে দূরে সরে যায়। এক্ষেত্রে জলাশয়ের মাছকে তার প্রকৃত অবস্থান থেকে কিছু টা উপরে মনে হয়।
জলাশয়ের মাছকে উপর থেকে দেখলে মাছকে তার প্রকৃত অবস্থানে না দেখিয়ে কিছুটা উপরে দেখায় কেন?

নক্ষত্র মিট মিট করে জ্বলে কেন?

রাতের আকাশে নক্ষত্রগুলো ঝিকমিক করে বা অমরা এটাকে মিট মিট করে জ্বলা বলে থাকি। খুব স্বাভাবিকভাবেই আমাদের মনে প্রশ্ন তৈরি হয়- রাতের আকাশে তারাগুলো কেন মিটি মিটি করে জ্বলে কেন?
নক্ষত্র বা তারাগুলো আমাদের থেকে অনেক অনেক আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত। বায়ুশূন্য মাধ্যমের মধ্যে দিয়ে নক্ষত্রগুলো থেকে আলো আমাদের পৃথিবীতে আসে। কিন্তু পৃথিবীর চারপাশে ৪০০ কিলোমিটারের বায়ুর আবরণ রয়েছে। এই বায়ু আবরণে বায়ুর উষ্মতার তারতম্য থাকায় এখানে ঘনমাত্রার পার্থক্য রয়েছে। ভিন্ন ভিন্ন ঘনমাত্রার বায়ু মাধ্যম ভেদ করে নক্ষত্র থেকে আলোক রশ্মি আমাদের চোখে এসে পড়ে। এসময়  আলোক রশ্মির বহুবার প্রতিসরণ ঘটে। আলোক রশ্মির এই গতিপথ পরিবর্তনের কারনে নক্ষত্রকে মিটমিট করে জ্বলছে বলে মনে হয়। 
তেলে ভেঁজানো কাগজকে সামন্য স্বচ্ছ মনে হয় কেন?
তেলে ভেঁজানো কাগজ সামান্য স্বচ্ছ দেখায় । কাগজের তল অমসৃণ । তাই অমসৃণ তলে আলোর বিক্ষিপ্ত প্রতিফলন ঘটে। কিন্ত কাগজকে তেলে ভেঁজানো হলে কাগজের ফাঁকে তেল ঢুকে যায়। যার ফলে এর ওপর আলোক রশ্মি পড়লে তা পরিসৃত হয়, তাই কাগজটিকে সামান্য স্বচ্ছ দেখায়। 

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url