বংশগত রোগ কি?|| বাংলাদেশের বংশগত রোগগুলো || জেনেটিক রোগ প্রতিরোধ করার উপায়||

বংশগত রোগ কি?|| বাংলাদেশের বংশগত রোগগুলো || জেনেটিক রোগ প্রতিরোধ করার উপায়||

বংশগত রোগ
বংশগত রোগ

বংশগত রোগ কি?

আমরা জানি, জীনকে বংশগতির ধারক ও বাহক। জীনের মাধ্যমে বাবা মায়ের বৈশিষ্ট সন্তান সন্ততিদের মাঝে ছড়িয়ে যায়। বাব-মায়ের বৈশিষ্ট সন্তানদের মধ্যে সঞ্চারিত হওয়াকে বংশগতি বলা হয়। আর বংশগতিক কারনে  বাব-মায়ের যেসব রোগ সন্তানদের মধ্যে সঞ্চারিত হয় সে সব রোগকেই বংশগত রোগ বলা হয়।

বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি বংশগত রোগগুলো হচ্ছে—

  • এনিমিয়া
  • ব্রেস্ট ক্যানসার, 
  • ফুসফুসের ক্যানসার, 
  • হিমোফিলিয়া
  • সিস্টিক ফাইব্রোসিস
  • মাসকুলার ডিসট্রফি
  • থ্যালাসেমিয়া
  • কোলন ক্যানসার ইত্যাদি
  • ডাওন সিনড্রোম
  • ডায়াবেটিস

ডায়াবেটিসঃ

ডায়াবেটিস হল এমন এক ধরনের রোগ যা হলে শরীরে গ্লুকোজের পরিমান বেড়ে যায়। দীর্ঘমেয়াদি সময় ধরে যখন শরীরে গ্লুকোজের পরিমান স্বাভাবেকের চেয়ে বেড়ে যায়, কারন শরীরে যথেষ্ট পরিমান কোন ইনসুলিন উৎপাদন করে না তখন তাই ডায়বেটিস নামে পরিচিত। ডায়বেটিস একটি দীর্ঘমেয়াদি রোগ। 

ডায়বেটিস রোগের লক্ষনসমুহঃ

  • ঘনঘন প্রসাব অনুভব করা।
  • দুর্বল অনুভুত হওয়া
  • ক্ষূধা বেড়ে যাওয়া। 
  • মিষ্টি জাতীয় জিনিসের প্রতি আকর্ষন বেড়ে যাওয়া।
  • কোন কারন ছাড়াই অনেক ওজন কমে যাওযা।
  • চামড়া খসখসে হয় যাওয়া। 
  • মেজাজ খিটখিটে লাগা । 
  • চোখে কম দেখা। 

কী করলে ডায়বেটিস ঠেকানো যায়ঃ

  1. প্রতিদিন এক ঘন্টা করে নিয়মিত হাটার অভ্যাস করা। 
  2. জীবন ধারা পাল্টে দিতে হবে। চিনি জাতীয় খাবার কম খাওয়া। 
  3. ধূমপান এর বদঅভ্যাস থাকলে তা পরি হার করা। 
  4. মদ্যপান ছেড়ে দিতে হবে। 
  5. মিষ্টি জাতীয় খাবার সম্পূর্ন বাদ দিতে হবে।
  6. রক্তে চিনির মাত্রা কমাতে হবে। তা নিয়মিত পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে। 

এনিমিয়াঃ

মানব দেহে লাল কনিকার পরিমান কমে যাওয়া বা হিমোগ্লোবিনের (BRC) পরিমান কমে যাওয়া কে এনিমিয়া বলা হয়। সময় মত চিকৎসা না নিলে রোগীর মারা যাওয়ার ঝুকি রয়েছে। 

রোগের লক্ষণঃ

  • শরীর খুব দুর্বল হয় । 
  • নিঃশ্বাষ নিতে সমস্যা হয়। 
  • অস্বস্তিকর অনুভুতি হয়।
  • মাথা ঘোরা সমস্যা দেখা যায়। 
  • কর্মক্ষমতা হ্রাস পায়। 
  • মাথা ব্যাথা 
  • মানব দেহে লাল কনিকার পরিমান কমে যাওয়া বা হিমোগ্লোবিনের পরিমান কমে যায়। 

এনিমিয়ার রোগের চিকিৎসাঃ

  • ডাক্তারের চিকিৎসা অনুযায়ী লৌহ , ভিটামিন ১২ এবং  ফলিক এসিড গ্রহন করা । 
  • ভিটমিন যুক্ত খাবার যেমন- লৌহ আছে এমন খাবার খাওয়া। 
  • সবুজ পাতাযুতক্ত সবজি তাজা ফল ডিম মাংস খাদ্য হিসাবে গ্রহন করা। 
  • ভিটামিন যুক্ত খাবার যেমন- লেবু , কমলা লেবু আম খেতে হবে।
  • বাচ্চাদের পেটের কৃমি দূর করতে সময়মত আলবেনডাজোল খেতে হবে।
  • এনিমিয়া থাকুক বা না থাকুক কিশোর মেয়েদের এবং গর্ভবতী মায়েদের লৌহ ও ফলিক এসিড খেতে হবে। 

হিমোফিলিয়াঃ

শরীরের কোথাও কেটে গেলে সেখানে রক্ত জমাট বাধতে যথেষ্ট দেরি হলে তা হিমোফিলিয়া রোগ। মানব দেহে রক্ত জমাট বাধতে ১ থেকে ১২ টি ফ্যাক্টর কাজ করে। এছাড়াও আরো অনেক ফ্যাক্টর আছে যেগুলো রক্ত জমাট বাধতে সাহায্য করে। সাধারনত মানব দেহে অ্যান্টিহিমোফিলিক গ্লোবিউলিন না থাকলে হিমোফিলিয়া রোগে আক্রান্ত হয়। মেয়েদের ক্ষেত্রে x ক্রোমোজোম ত্রুটিপূর্ণ জীন থাকলে সে হিমোফিলিয়া রোগে আক্রান্ত হয়। 

হিমোফিলিয়ার লক্ষণঃ

  • কেটে গেলে রক্ত বন্ধ না হওয়া। 
  • পড়ে গিয়ে পেশিতে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভূত হওয়া। 
  • মাথায় আঘাত লাগার সঙ্গে সঙ্গে আঘাত প্রাপ্ত অংশ ফুলে যাওয়া,
  • আঘাত প্রাপ্ত ফোলা অংশ কমতে সময় নেওয়া— এ সবই হিমোফিলিয়ার লক্ষণ। 

ব্রেস্ট ক্যানসারঃ

বাংলাদেশে ক্যান্সারে আক্রান্ত নারিদের মধ্যে স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। দিন দিন এ ই আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। চিকিৎসকদের মতে, স্তনের মধ্যে কিছু কোষ অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গেলে অনিয়মিত ও অতিরিক্ত কোষগুলো বিভাজনের মাধ্যমে পিন্ড বা চাকতির মত অবস্থা তৈরি করে তখন তাই স্তন ক্যান্সার । 

স্তন ক্যান্সারের কারনঃ

খাদ্যাভাসের পরিবর্তন ও জীবনাচারের অস্বাভাবিক পরিবর্তন ক্যান্সার এর ঝুকি বাড়িয়ে দেয়। 
মেয়েদের বার বছরের আগে  ঋতুস্রাব হওয়া এবং তা দেরিতে বন্ধ হওয়া। 
তেজস্ক্রিয়তা স্তনক্যান্সারের ঝুকি বাড়িয়ে দয়ে। 

কখন চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে?

  • স্তনে পিণ্ড অথবা চাকা দেখা দিলে
  • স্তনের বোঁটার পরিবর্তন,  লক্ষ্য করা গেলে। যেমন স্তনের বোঁটা ভেতরে ঢুকে গেলে, বাঁকা হয়ে গেলে বা  অসমান।
  • স্তনের বোঁটা কেথে অস্বাভাবিকভাবে রস বের হলে
  • স্তনের চামড়ার রং অথবা স্তনের আকার বা  চেহারায় পরিবর্তন হলে
  • হাতের গোড়ায় বা বাহুমূলে পিণ্ড বা চাকা দেখা গেলে।

ডাউন সিনড্রোমঃ

ক্রোমোজমে কিংবা ডিএনএ এর যদি কোনও অসামঞ্জস্যতা দেখা দেয়, সেক্ষেত্রে মানসিক এবং শারীরিক ত্রুটি দেখা যায়। এই ধরনের রোগকেই বলা হয় ডাউন সিনড্রোম রোগ। এই রোগ সাধারণত জেনেটিক সমস্যার কারণেই হয় একে জেনেটিক ডিসঅরডার বলা হয়।
*কেন হয় ডাউন সিনড্রোম? কোন লক্ষণ দেখে বুঝবেন?
কী ত্রুটির কারণে এমনটা হয়? ভ্রুণে ২৩ জোড়া ক্রোমোজম থাকে। ডাউন সিনড্রোম হলে আরও একটি বাড়তি ক্রোমোজম ২১ নম্বর ক্রোমোজম জোড়ের জায়গায় ঢুকে পড়ে৷ তখন ২১তম স্থানে ক্রোমোজমের সংখ্যা ২টির বদলে হয়ে যায় ৩টি। একে 'ট্রাইসোমি ২১'।

কেন হয় ডাউন সিনড্রোম? ডউনসিনড্রোম এর লক্ষণ?

সিনড্রোম দিবস হিসাবে ২১ মার্চ কে বিশ্ব ডাউন পালিত হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে,তুলনামুলকভাবে বেশি বয়সে মা হলে বিশেষ করে ৩৫ বছর বয়সের পরে সন্তান নিলে সেই সন্তানের মধ্যে  ডউনসিনড্রোম এর বৈশিষ্ট্যগুলো থাকতে পারে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) রিপোর্ট অনুযায়ী, আমাদের দেশে প্রতিবছর পাঁচ হাজার ৫০০ বা প্রতিদিন প্রায় ১৫টির বেশি ডাউন শিশুর জন্ম হয়। এদের সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছ।
ব্রিটিশ চিকিৎসক জন ল্যাঙ্গডন ডাউন সিনড্রোম শব্দটির ব্যবহার শুরু করেন। তিনি সর্বপ্রথম ১৮৬৬ সালে এই শিশুদের চিহ্নিত করেন।
ডাউন সিনড্রোমের ক্ষেত্রে কিছু শারীরিক এবং মানসিক বৈশিষ্ট্য পার্থক্য থাকে। যেমন- কম উচ্চতা,ছোট কান, চ্যাপ্টা নাক, হাতের তালুতে একটি মাত্র রেখা।


কাদের জেনেটিক টেস্ট দরকারঃ

যে সব মায়েদের পূর্ববর্তী সন্তানদের এই ধরনের রোগ আছে, তাদের পরবর্তী সন্তানদের রোগ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই এদের জেনেটিক টেস্ট দরকার।
যারা ৩৫ বছরের পরে বাচ্চা নিতে চান তাদের জেনেটিক টেস্ট দরকার।
যেসব পরিবারের জেনেটিক রোগের রয়েছে সেসব পরিবারের সদস্যদের সন্তান নেওয়ার সময়।
গর্ভকালীন যদি বাচ্চা খুবই কম বাড়ে।
আত্মীয়স্বজনের মধ্যে বিবাহত নারী-পুরুষদের (মামাতো, চাচাতো, ফুফাতো ভাই বোন) জেনেটিক টেস্ট প্রয়োজন।
বাচ্চা গর্ভপাত হয়ে যায় এমন নারীদের জেনেটিক টেস্ট করা দরকার।

জেনেটিক রোগের জন্য যে ধরনের টেস্ট করা হয়—

ক্রোমোজোমের বিশ্লেষণঃ

সাধারণত গর্ভকালীন থাকা বাচ্চার কর্ড থেকে রক্ত, ক্রোরিওনিক ভিলাই, এমনিউটিক তরল  ক্রোরিওনিক ভিলাই এবং অন্যান্য  উপাদান নিয়ে পিসিআর করার মাধ্যমে ক্রোমোজোমের বিশ্লেষণ করা হয়, ।

কারিওটাইপিংঃ 

আমাদের ক্রোমোজোম সংখ্যা ৪৬ টি। সুতরাং ক্রোমোজোম সংখ্যা কম না বেশি, তা টেস্ট দিয়ে বোঝা যাবে।
*রিকম্বিনেন্ট ডিএনএ টেকনোলজি টেস্ট
*রেস্ট্রিকশন ফ্র্যাগমেন্ট বিশ্লেষন করা।

হিমোগ্লোবিন ইলেকট্রোফোরেসিসঃ

থ্যালামেসিয়া আছে কি না তা যাচাই করা এবং তা কোনো টাইপের নির্ণয় করা।

ক্লটিং ফ্যাক্টর বিশ্লেষণঃ

হেমোফাইলিয়া এ এবং বি নির্ণয় করা যায়।
বিভিন্ন রকম হরমোন টেস্ট, যেমন— সেক্স হরমোন লেভেল, গ্রোথ হরমোন, থাইরয়েড হরমোন দিয়ে হরমোনাল রোগগুলো নির্ণয় করা।


জেনেটিক রোগ প্রতিরোধ করার উপায়

বাবা মায়ের বংশগত রোগ থাকলে সন্তান সন্ততির মধ্যে রোগ গুলো সঞ্চারিত হয়।  
১. বংশগত রোগ প্রতিরোধের জন্য নিকট আত্নীয় স্বজনদের যেমন- চাচাতো, মামাতো, ফুফাতোসহ অন্যান্য দেরকে বিয়ে না করা।
২. মেয়েদের ৩৫ বছরের পরে বাচ্চা না নেওয়া আর বাচ্চা নিলেও তা জিনেটিক টেস্ট করে যাচাই করার পর বাচ্চা নেওয়া।
৩. বংশগত রোগ হওয়ার আশঙ্কা থাকলে বাচ্চা না নেওয়াই ভাল।
৪. বিয়ে এবং বাচ্চা নেওয়ার আগে বিশেষজ্ঞ কাউকে দিয়ে জেনেটিক কাউন্সেলিং করলে বংশগত রোগ হতে মুক্ত থাকার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
৫. বাবা মায়ের জন্য যেন সন্তানদের কোন সমস্যা না হয় এজন্য বাবা মাদের সচেতন হতে হবে।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url