আর্থরাইটিস কি? আর্থরাইটিসের কারণ, লক্ষণ ও প্রতিকার।

আর্থরাইটিস কি? আর্থরাইটিসের কারণ, লক্ষণ ও প্রতিকার।

আর্থরাইটিস কি? আর্থরাইটিসের কারণ, লক্ষণ ও প্রতিকার।



আমাদের চারপাশের মানুষদের মধ্যে অনেককেই আর্থরাইটিস সমস্যায় ভুগতে দেখি। বর্তমান পৃথিবীর বিশাল পরিমান মানুষ এই রোগে আক্রান্ত। সাধারনত বয়ষ্ক মানুষদের এই সমস্যায় পড়তে দেখা যায়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আর্থরাইটিস রোগের কারন কি? আর্থরাইটিস রোগ হলে কি কি সমস্যা তৈরি হয়? আর্থরাইটিস রোগের প্রতিকার কি ? এসব প্রশ্নের উত্তর জানতে লেখাটি সম্পূর্ন পড়ুন। 


আর্থরাইটিস কি?

প্রকৃতপক্ষে আর্থরাইটিস আসলে কোন রোগ নয়। সাধারনত হাড়ের জয়েন্ট সংলগ্ন স্থানে যে কোনো ব্যাথা হলে সেই ব্যাথাকে আর্থরাইটিস বলা হয়। আর্থরাইটিস যেকোনো বয়েস বা যেকোন লিঙ্গের মানুষের মধ্যেই দেখা দিতে পারে। পৃথিবীতে  প্রায় ১০০টি বিভিন্ন ধরণের বাত বা আর্থরাইটিস রোগের কথা শুনতে পাওয়া যায়।  তবে এই রোগটি বয়ষ্ক বা প্রবীণদের মধ্যে বেশি দেখা যায়। 

শূধূ ভারতেই ১৫% লোক আর্থরাইটিস রোগে আক্রান্ত । অন্যান্য রোগ যেমনঃ ডায়াবেটিস,ডায়রিয়া,  ক্যান্সার, ইত্যাদি রোগ এর চেয়েও এই রোগে ভুক্তভুগি মানুষের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি। বহুকাল থেকেই এই রোগটি মানুষের মধ্যে প্রচলিত হয়ে আসছে। খ্রিস্টপূর্ব ৪৫০০ আগেই এব রোগ সম্পর্কে মানুষের মধ্যে ধারনার সৃষ্টি হয়েছিল। ১৮৫৯ সালে এই রোগটিকে আর্থরাইটিস নামে নামকরন করা হয়। 

আর্থরাইটিস ফাউন্ডেশন “আটলান্টা এর দেওয়া তথ্যের আলোকে জানা যায় , বিশ্বের অক্ষম মানুষদের অর্ধেকই আর্থরাইটিস রোগে আক্রান্ত। বাংলাদেশের প্রায় ২৫ শতাংশ মানুষ-ই আর্থরাইটিস রোগে আক্রান্ত । শুধুমাত্র আমেরিকাতেই সাত মিলিয়ন মানুষ আর্থরাইটিস এ আক্রান্ত । 


যাদের আর্থরাইটিস হয়?

সাধারনত যাদের বয়ষ বেশি তাদের আর্থরাইটিস। যেমনঃ ৬৫ বছরের বেশি বয়সী মানুষদের আর্থরাইটিস রোগ হয়ে থাকে।

পুরুষদের ৪৫ আর নারীদের ৪৫ এর বেশি বয়ষ হলে আর্থরাইটিস রোগ এর সম্ভাবনা তৈরি হয়। 
অস্থি বা হাড়ে আঘাত লাগলে আর্থরাইটিস রোগ হতে পারে। 

যাদের শরীরের ওজন বেশি তাদের এই রোগ সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে। 
কিছু ক্ষেত্রে বংশগত কারনেও আর্থরাইটিস রোগ হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়। 


আর্থরাইটিস রোগ নির্ণয়
আর্থরাইটিস রোগের ইতিহাস ও রোগের ধরন দেখে রোগ নির্ণয় করা হয়ে থাকে। অনেক ক্ষেত্রে আরো কিছু বিষয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে এই রোগ নির্ণয় করা হয়ে থাকে। কিছু ক্ষেত্রে এক্স-রে, জয়েন্ট অ্যাসপিরেশন ইত্যাদি করার পর আর্থরাইটিস রোগ নির্ণয় করা হয়। 



আর্থরাইটিস এর কারণ কি কি?

আর্থরাইটিস রোগটি বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে। আর্থরাইটিস রোগের কারণ নির্ভর করে, আর্থরাইটিস রোগের ধরনের ওপর ।  আর্থরাইটিস রোগের সাধারন কিছু কারন উল্লেখ করা যেতে পারে। 

ক্ষয়িষ্ণু বাত বা আর্থরাইটিসঃ 
সব চেয়ে সাধারণ ধরণের বাত হল অস্টিও-আর্থরাইটিস । যখন হারের কার্টিলেজ ক্ষয়ে যায় এবং একটি হাড় অন্য হাড়ের  ওপর ঘষা লাগে এবং তার ফলে হাড়ের জয়েন্ট এ ব্যাথা অনুভুত হয়, জয়েন্টএ ফোলা ভাব এবং আড়ষ্ঠতা তৈরি হয়। সময়ের সাথে সাথে জয়েন্ট গুলো  তাদের জোর হারায়ে এবং ব্যাথার পরিমান ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। সাধারনত শরীরের অতিরিক্ত ওজন, বার্ধক্য এবং কোনো পূর্ব শারীরিক আঘাত  বাত বা আর্থরাইটিস এর সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়। 

সংক্রামক বাতঃ
অনেক সময় শরীরে সংক্রামকদের পরিমান বেড়ে যায়।  বিভিন্ন রোগ বহনকারী জীবাণু যেমনঃ ছত্রাক, ব্যাকটেরিয়া ইত্যাদি, হাড়ের জয়েন্টএ ঢুকে গিয়ে প্রদাহ সৃষ্টি করে। এসব জীবাণু মানুষের শরীরের বিভিন্ন জয়েন্টএ ঢুকে এই বাত তৈরী করে। এ ধরনের আর্থরাইটিস বা বাত হলো শিজেলা, ক্লামাইডিয়া, স্যালমনেলা ( খাদ্যের মাধ্যমে), এবং গনোরিয়া (যৌন রোগ এর মাধ্যমে) এবং হেপাটাইটিস সি।

প্রদাহজনক বাতঃ
অটোইমিউন প্রতিক্রিয়ার কারণে প্রদাহজনক বাত বা আর্থরাইটিস হয়। অটোইমিউন প্রতিক্রিয়ার কারণে আরো কিছু রোগ হয় যেমন্ঃ  রিউমাটয়েড আর্থরাইটিস, সোরিয়াটিক আর্থ্রাইটিস, ইত্যাদি।  এই রোগ ঘটে যখন শরীরের নিজস্য রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা শরীরের নিজস্য হাড়ের জয়েন্টকেই আক্রান্ত করে, যার ফলে প্রদাহ হয়। বৈজ্ঞানিকরা মনে করেন, বিভিন্ন প্রাকৃতিক কারণে এবং জেনেটিক কারনে  এই অটোইম্যুনিটি তীব্র হয়ে উঠতে পারে। ধূমপান, এমনি এক প্রাকৃতিক ঝুঁকি যার কারনে রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস ঘটাতে পারে।

বিপাকীয় বাতঃ
হাড়ের জয়েন্টে অতিরিক্ত ইউরিক অ্যাসিড জমে যাওয়ার ফলে, বিপাকীয় বাত হয়ে থাকে। কখনও কখনও ইউরিক অ্যাসিড হাড়ের জয়েন্টে জমে গিয়ে জয়েন্ট এর মধ্যে  স্ফটিক তৈরী করে যা আকস্মিকভাবে অতিরিক্ত জয়েন্ট এ যন্ত্রনা তৈরী করে।



আর্থ্রাইটিসের লক্ষণ গুলি কি কি?

  • জ্বর হওয়া, 
  • শরীরের ওজন হ্রাস পাওয়া,
  • অসুস্থ বোধ (অসুস্থতা),  
  • শরীরের গ্রন্থি ফোলা, 
  • ক্লান্তি অনুভূত হওয়া, 
  • ফুসফুস, হার্ট বা কিডনির মতো অঙ্গগুলির অস্বাভাবিকতা হওয়া ইত্যাদি।



আর্থ্রাইটিস প্রতিরোধের উপায় 

>> আর্থ্রাইটিস রোগ হলে  শারীরিক তৎপরতা বাড়ানো প্রয়োজন। যেমনঃ-  যানবাহনে ওঠার আগে অন্তত ৫০০ মিটার পথ পায়ে হেঁটে যাওয়া এবং বহুতল ভবনে ওঠার সময় মাঝেমধ্যেই লিফট ব্যবহার না করে সিড়ি ব্যবহার করা। সকাল বিকাল হাঁটা হাঁটি করা । হালকা খেলাধুলা করা উচিত। 

=>>সকাল সন্ধ্যা হালকা থেকে মাঝারি ধরনের ব্যায়াম করা এবং  শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।

=>>  মানসিক চাপ যথাসম্ভব কম রাখা । নামায-কালাম পড়া এবং মেডিটেশনের মতো কাজের চর্চা করা।

=>> শরীরের জয়েন্টগুলোতে আবার নতুনভাবে জখম যেন না হয় সে ক্ষেত্রে সাবধান থাকা এবং ইতোমধ্যেই আঘাত প্রাপ্ত হয়ে থাকলে তা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করা । আক্রান্ত হয়ে থাকলে তা দ্রুত সারিয়ে তোলা।

=>> প্রতিদিন পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি পান করা । খাবারের তালিকায় ক্যালসিয়ামযুক্ত খাবার রাখা । ভিটামিনযুক্ত খাবার বেশি খেতে হবে। 

=> >ছোটখাটো জখম  হলে দ্রুত চিকিৎসার মাধ্যমে করানো। 

=>>কোনভাবেই ধূমপান না করা। মদপান করা থেকে বিরত থাকা । কারণ ধুমপান , মদ হাড়ের স্বাস্থ্য ও কাঠামো দূর্বল করে দেয়।


=>> নিয়মিত দুধ পান করতে হবে।

=>> মেনোপোজ পরবর্তীকালীন সময়ে নারীদের জন্য হরমোন  অতিরিক্ত ক্যালসিয়াম প্রতিস্থাপন, ও ভিটামিন ডি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

=> > মাপে সঠিক সাইজের এবং নরম জুতা ব্যবহার করতে হবে।

=>> প্রদাহসৃষ্টিকারী খাবার এড়িয়ে চলুন। প্রায়ই দেখা যায় যে, লবন, চিনি, মিষ্টি, মদ, ক্যাফেইন, প্রক্রিয়াজাতকৃত মাংস, সাধারণ রান্নার তেল, ট্রান্স ফ্যাট ও লাল মাংস ক্যান্সার ও হৃদরোগসহ অসংখ্য রোগের জন্ম দেয়।

=>> ঠান্ডা লাগলে আর্থ্রাইটিস বা বাতের  ব্যথা ও সমস্যা বেড়ে যায়, তাই যথাসম্ভব ঠান্ডা থেকে দূরে থাকতে হবে।

=>> কুসুম কুসুম গরম পানির সেঁক ব্যাথা নিরাময়ে কার্যকরী ভুমিকা পালন করে। নিয়মিত কুসুম গরম পানিতে গোসল করা যেতে পারে।



আর্থ্রাইটিসের চিকিৎসা কি ?

আর্থ্রাইটিসের  চিকিৎসার মধ্যে থেরাপি  এবং  স্ব-যত্ন এবং খুব জরুরি। আর্থ্রাইটিসে ওষুধ, ফিজিওথেরাপি দিতে হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সার্জারি ব্যাথা কমাতে সাহায্য করে এবং স্বাভাবিক জীবনের চাল চলনে উন্নতি আনে।

স্ব-যত্নঃ
নিয়মিত অনুশীলন, হিটিং প্যাড অ্যাপ্লিকেশন,  যোগ, কোল্ড কমপ্রেস এবং আইস প্যাক লাগানো এবং অন্যান্য ঘরোয়া চিকিৎসা ইত্যাদি খুব উপকারী। 

থেরাপিঃ
হাইড্রোথেরাপি, আকুপাংচার, ফিজিওথেরাপি,  ইত্যাদি আর্থ্রাইটিসের  চিকিৎসায় কার্যকরী ।

সার্জারিঃ
রোগের ধরন অনুযায়ী হাড়ের জয়েন্ট রিপ্লেসমেন্ট করানো যেতে পারে । এটা করতে সার্জারি করতে হবে ।
  
ওষুধঃ
আর্থ্রাইটিসের  চিকিৎসায় বিভিন্ন ধরনের ওষুধ রয়েছে। যেমনঃ অ্যানালজেসিকস, মাদকদ্রব্য, প্রদাহবিরোধক ওষুধ, ইমিউনোসপ্রেসিভ ড্রাগগুলি ইত্যাদি। 

আর্থ্রাইটিসের  চিকিৎসায় কিছু প্রাকৃতিক চিকিৎসা বা ন্যাচারাল পদ্ধতি প্রচলিত রয়েছে। যেমনঃওমেগা -3 ফ্যাটি অ্যাসিড সমৃদ্ধ খাবার,  কিছু কিছু গুল্মের পরিপূরক, ভিটামিন ডি এবং গরম পানির ছ্যাকা ইত্যাদি প্রভাবগুলি হ্রাস করতে সাহায্য করে।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url