মোবাইল ফোন বা ডিজিটাল ডিভাইস সত্যিই কি ক্যান্সার সৃষ্টির জন্য দায়ী?

মোবাইল ফোন vs ক্যান্সার। মোবাইল ফোন বা ডিজিটাল ডিভাইস সত্যিই কি ক্যান্সার সৃষ্টির জন্য দায়ী?

ক্যান্সার এর কারন; ক্যান্সার কেন হয়; কিভাবে ক্যান্সার হয়; মোবাইল রেডিয়েশন কি ক্যান্সারের জন্য দায়ী; মোব্‌ইল ফোনের কারনে কি ক্যান্সার হয়্; মোবাইল ক্যান্সার এর জন্য দায়ী নয়;
ক্রোমোজোম

নিত্য প্রয়োজনে মানুষকে বিভিন্ন রকম ডিজিটাল ডিভাইস গুলো ব্যবহার করতে হয়। এসব ডিভাইস ব্যবহার করার যেমন ভাল দিকের পাশাপাশি নানান ক্ষতকর দিকের কথাও আমরা শুনতে পাই। আমাদের 
মনে প্রায়ই  একটি প্রশ্ন দেখা দেয়-  বহুল ব্যবহ্নত আমাদের প্রিয় মোবাইল ফোনটি আমাদের দেহ মনে কোন ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে না তো। আবার আমাদের মধ্যে  কেউ কেউ বলেই থাকেন স্মার্টফোন থেকে নির্গত রেডিয়েশন এর কারনে ক্যান্সার রোগ হয়। আজকে আমরা অনুসন্ধান করব , মোবাইল ভার্সেস ক্যান্সার অর্থাৎ মোবাইল থেকে ই কি তাহলে ক্যান্সার রোগ হচ্ছে???

এই বিষয়টি ভালভাবে জানার জন্য, প্রথমেই আমাদেরকে বুঝতে হবে আসলে ক্যান্সার কী এবং ক্যান্সার হলে কি হয় তা - পৃথিবী ব্যাপী ক্যান্সার একটি মারাত্বক রোগ। চিকিৎসা বিজ্ঞানে অনিয়ন্ত্রিত কোষ বিভাজনকে মূলত  ক্যান্সার বলা হয়। সময়ের সাথে সাথে ক্যান্সার আক্রন্ত রোগীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে।  

২০১৮ সালের হিসাব অনুযায়ী ক্যান্সার রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায় ৯৬ লক্ষ্য মানুষ। এবং ২০৩০ সালে এসে এই হিসাব বেড়ে হবে ১ কোটি ৩০ লক্ষ্য। বাংলাদেশে প্রায় বিশ লাখ মানুষ ক্যান্সার রোগে আক্রান্ত। প্রতি বছর বাংলাদেশের এক থেকে দেড় লাখ মানুষ ক্যান্সার এ মারা যায়। সেই হিসেব অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রতিদিন ক্যান্সার এ আক্রান্ত হয়ে মারা যায় ২৭৩ জন মানুষ। 

 

যাইহোক, আমাদের আলোচনার বিষয় হলো - মোবাইল ফোন এবং ক্যান্সার ।

অনেক মানুষ মনে করেন তাদের হাতে থাকা মোবাইল ফোনটি তাদের শরীরে ক্যান্সার সৃষ্টি করতে পারে। এই ভাবনা মোটেও অমূলক নয়। কারণ আমরা এমন একটি ডিভাইস ব্রেইনের পাশেই ধরে আছি যা অনবরত রেডিয়েশন নির্গত করে যাচ্ছে । এখন প্রশ্ন হচ্ছে- মোবাইল ফোন কি আসলেই ক্যান্সার সৃষ্টি করতে পারে? উত্তরটা জানার জন্যে প্রথমেই বুঝতে হবে রেডিয়েশন কি? রেডিয়েশন হচ্ছে ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ওয়েভ যা এক স্থান থেকে অন্য স্থানে আলোর গতিতে শক্তি পরিবহন করে। খুব সহজ করে বললে রেডিয়েশন হচ্ছে আলো যার নির্দিষ্ট একটি পরিসর আমরা দেখতে পাই।রেডিয়েশন বা আলো কতটা শক্তি সম্পন্ন তার ওপর ভিত্তি করে রেডিয়েশনকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়।

 নন আয়োনাইজিং রেডিয়েশন যেমন রেডিও ওয়েভ, মাইক্রোওয়েভ। 

আয়োনাইজিং রেডিয়েশন যেমন গামারে, এক্সরে যেসকল রেডিয়েশনের তরঙ্গদৈর্ঘ্য বেশি অর্থাৎ ফ্রিকোয়েন্সি কম তারা কম শক্তি সম্পন্ন।


রেডিয়েশন ফ্রিকোয়েন্সি
রেডিয়েশন ফ্রিকোয়েন্সি

এ ধরনের রেডিয়েশন যখন পরমাণু কে আঘাত করে তখন তা কম শক্তিসম্পন্ন হওয়ায় পরমাণুর ইলেকট্রনকে স্থানচ্যুত করতে পারে না তাই তাদেরকে নন আয়োনাইজিং রেডিয়েশন বল। নন আয়োনাইজিং রেডিয়েশন মানুষ বা অন্য কোন প্রাণীর কোষের কেমিক্যাল বন্ড ভাঙতে পারে না ডিএনএ নষ্ট করতে পারে না। সুতরাং এ ধরনের রেডিয়েশনের মাধ্যমে ক্যান্সার হবার কোন সম্ভাবনা নেই। অন্যদিকে যেসব রেডিয়েশনের তরঙ্গদৈর্ঘ্য কম অর্থাৎ ফ্রিকোয়েন্সি বেশি তারা বেশি পরিমাণ শক্তি বহন করে। এই ধরনের রেডিয়েশন যখন পরমাণুকে আঘাত করে তখন এদের শক্তি বেশি থাকায় তারা পরমাণুর ইলেকট্রনকে স্থানচ্যুত করে ফেলে তাই এদের আয়োনাইজিং রেডিয়েশন বলে। এধরনের high-energy সম্পূর্ণ রেডিয়েশন কোষের রাসায়নিক বন্ধন(কেমিক্যাল বন্ড) ভেঙে ফেলে এবং ডিএনএ নষ্ট করে ফেলে যা ক্যান্সার সৃষ্টির কারণ।  


সুতরাং যত তীব্র রেডিয়েশন ই হোক না কেন যদি তা পরমানুর ইলেক্ট্রন বিচ্যুত করতে না পারে তবে তা ক্যান্সার সৃষ্টি করতে পারবে না । যেমনঃ মাইক্রোওভেন । মাইক্রোওভেন এ রেডিয়েশন অনেক বেশি কিন্তু ফ্রিকুয়েন্সি অনেক কম থাকার কারনে কোষের গঠন ভাংতে পারে না আর তাই মাইক্রোওভেন থেকে নির্গত রেডিয়েশন ক্যান্সার সৃষ্টি করতে পারে না । 

অর্থাৎ রেডিয়েশনের ফ্রিকুয়েন্সি যত বেশি , তার শক্তি তত বেশি। পক্ষান্তরে রেডিয়েশনের ফ্রিকুয়েন্সি যত কম , তার শক্তি তত কম।

আয়নাইজিং এব্ং নন আয়নাইজিং এর মধ্যর্তী ফ্রিকুয়েন্সি দৃশ্যমান আলোর । দৃশ্যমান আলোর ফ্রিকুয়েন্সি থেকে রেডিও ওয়েব এর ফ্রিকুয়েন্সি অনেক কম। আর মোবাইল ফোনের ফ্রিকুয়েন্সি হলো এই রেডিও ওয়েব ফিকুয়েন্সি । 



সকালবেলা যে মিষ্টি আলো দেখে আমরা মুগ্ধ হই আবার দুপুরের কড়া আলোই আমরা বিরক্ত হই এই আলোর শক্তি থেকেও মোবাইল ফোনে ব্যবহৃত আলো অর্থাৎ রেডিও ওয়েবের শক্তি কম। সুতরাং মোবাইল ফোনের রেডিয়েশন থেকে ক্যান্সার হবার কোন সম্ভাবনাই নেই। কিন্তু তারপরেও ডাক্তার এবং অনেক গবেষকগণ মোবা্ইল এবং ক্যান্সার নিয়ে অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছেন। প্রথমদিকের কিছু গবেষণা দেখলে এমনটা মনে হতে পারে যে মোবাইল ফোন এবং ক্যান্সারের মধ্যে সম্পর্ক রয়েছে। যেমন UK তে একটি গবেষণা হয়েছিল 10 লক্ষ মহিলার উপর। তারা একধরনের টিউমার যাকে acostic neuroma বলে এর সাথে নিয়মিত মোবাইল ফোন ব্যবহারের কিছুটা সম্পর্ক থাকার কথা উল্লেখ করেছিল ফলে এই বিষয়টি নিয়ে পরবর্তী সাত বছর পর্যবেক্ষণ করা হয়েছিল এটা জানতে যে আসলেই মোবাইল ফোন ব্যবহারের সাথে টিউমারের কোন সম্পর্ক আছে কিনা? যদি মোবাইল ফোন ব্যবহারের ফলে টিউমার সৃষ্টি হতো তবে অবশ্যই পরবর্তী সাত বছরে একোস্টিক নিউরোমা রোগীর সংখ্যা বাড়তো কিন্তু দেখা গেল যে একোস্টিক নিউরোমা রোগীর সংখ্যা বাড়েনি। এই একই বিষয় নিয়ে পরবর্তীতে আরও বড় পরিসরে গবেষণা হয় এবং তারা মোবাইল ফোনে ব্যবহারের সাথে একোস্টিক নিউরোমা টিউমারের কোন সম্পর্ক খুঁজে পাননি। আরো একটি বড় পরিসরে গবেষণা পরিচালিত হয় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্খা WHO এর অধীনে। তারা উল্লেখ করেন glioma হবার সম্ভাবনা 10% বৃদ্ধি পেতে পারে নিয়মিত মোবাইল ফোন ব্যবহারের ফলে। glioma এক ধরনের স্নায়ু কোষ যার কারণে malignant brain cancer হয়। কিন্তু এই গবেষণার একটি দুর্বল দিক বা এুটি রয়েছে। তারা মানুষের দেওয়া তথ্যের ওপর ভিত্তি করে এই পরিসংখ্যান প্রকাশ করেন।  দেন । সেদিক দিয়ে পরিসংখ্যানের গ্রহনযোগ্যতা কমে যায়। তৃতীয় কোন মাধ্যম যদি কিছু সংখ্যক মানুষকে পর্যবেক্ষনে রেখে কে কত সময় মোবাইল ব্যবহার করছে তা থেকে পরিসংখ্যান দিত তাহলে এর গ্রহনযোগ্যতা বেড়ে যেত। অন্যদিকে glioma একটি দু্র্লভ রোগ। প্রতি এক লক্ষ্য মানুষের মধ্যে glioma হওয়ার সম্ভাবনা মাত্র তিন জনের । এজন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা  WHO এর তথ্য শক্ত ভিত্তি তৌরি করতে পারেনি। তাছাড়া বিশ্বে বানিজ্যিকভবে মোবাইল বিক্রি শুরু হয় ১৯৮০ সাল থেকে । মোবাইল ফোন ব্যবহারে সত্যি ই যদি ক্যান্সার হত তাহলে পৃথিবীতে ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা চোখে পড়ার মত বেড়ে যেত কিন্তু তা হয়নি । 


সুতরাং আমরা বলতে পারি মোবাইল ব্যবহারের কারনে ক্যান্সার হয় , বিষয়টি মোটেই সত্য নয়।



Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url